Tuesday, September 27, 2016

কবির বিদায়


সৈয়দ শামসুল হক আর নেই

কবির বিদায়

লেখক সৈয়দ শামসুল হকের গুলশানের বাসভবনে গতকাল রাতে তাঁর স্ত্রী আনোয়ারা সৈয়দ হককে সান্ত্বনা দেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর l ছবি: প্রথম আলোচারদিকে রটে যায় এ খবর, সৈয়দ শামসুল হক আর নেই। গতকাল বিকেল পাঁচটা ছাব্বিশ মিনিটে ইউনাইটেড হাসপাতালে তিনি শেষ করলেন আশি বছরের জীবনের সব লেনদেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। ভুগছিলেন ফুসফুসের ক্যানসারে। তিনি স্ত্রী আনোয়ারা সৈয়দ হক, মেয়ে বিদিতা সৈয়দ হক ও ছেলে দ্বিতীয় সৈয়দ হককে রেখে গেছেন।

হাসপাতাল থেকে খবর আসে, কিছুক্ষণের মধ্যেই কবিকে নিয়ে আসা হবে তাঁর গুলশানের আবাস ‘মঞ্জুবাড়ি’তে। ভয়াবহ যানজটে স্থবির তখন রাজপথ। ভিড় ঠেলে এগিয়ে যায় আমাদের মোটরসাইকেল।

মঞ্জুবাড়ি তখন ফাঁকা। শুধু বাড়ির গৃহকর্মী তারেক, শাহ পরান আর আল আমীন বিষণ্ন মনে স্থবির দাঁড়িয়ে আছে। দরজা পেরিয়ে সেই বাড়িটির দিকে যাই, যেখানে সৈয়দ হক বহুদিন বাস করেছেন। উঠোনে গোল করে রাখা হয়েছে চেয়ার। তার আগে বেশ কিছু টুল। যাঁরা একটু পর এই বাড়িতে আসবেন, তাঁদের জন্যই এই আয়োজন। উঁকি মেরে ঘরের দিকে তাকাই। আলমারিতে বই, তার ওপরের তাকে অনেকগুলো ক্রেস্ট। ঘরে বঙ্গবন্ধুর বড় একটি ছবি, আরও ছবি সৈয়দ হকের। আল আমীন সে ঘরে ঢোকে। দ্রুত হাতে ঘরের সব ছবি সরিয়ে ফেলতে থাকে। সৈয়দ হককে গ্রহণের প্রস্তুতি।
ইউনাইটেড হাসপাতালে আরও কিছুক্ষণ রাখা হবে কবিকে—এ খবর জানতে পেরে আমরা সেদিকে যাই। হাসপাতালের নিচতলায় সে সময় ভিড়। সেখানে আছেন ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হক, চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর, পরিচালক ও বার্তাপ্রধান শাইখ সিরাজ, নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম, অভিনয়শিল্পী তারিক আনাম খান, নিমা রহমান, কবি তারিক সুজাত। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিকেরা কথা বলছেন তাঁদের সঙ্গে। একটু আগে সংস্কৃতিমন্ত্রী এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ আরও অনেকে ছিলেন এখানে।
মেয়র আনিসুল হক বললেন, ‘এক দিনে এক শতাব্দী শেষ হয়ে গেল।’ ফরিদুর রেজা সাগর বললেন, ‘মানুষের হৃদয়ে, মানুষের চোখের সামনে সব সময় তিনি ছিলেন। আজ এক মুহূর্তে সেই যুগের অবসান হলো। কিন্তু এটাও সত্য তিনি বাঙালির হৃদয়ে আরও অনেক যুগ বেঁচে থাকবেন।’
একজন সুহৃদ এসে জানালেন, হাসপাতালের অন্য দরজা দিয়ে সৈয়দ হককে নিয়ে লাশের গাড়ি মঞ্জুবাড়ির দিকে রওনা হয়ে গেছে। গুলশান এক নম্বর গোলচত্বরের কাছে আমরা পেয়ে যাই লাশের গাড়ি। কিছুক্ষণ আমরা কবির পাশে পাশে চলি।
মঞ্জুবাড়িতে তখন একটু একটু করে ভিড় বাড়ছে। এসেছেন অভিনয়শিল্পী গাজী রাকায়েত ও আফসানা মিমি, কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক, কবি টোকন ঠাকুর।
সব্যসাচী লেখককে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স এল। তাঁকে রাখা হলো বারান্দায়। শোক-ভারাক্রান্ত মানুষ কাঁদতে ভুলে গেছে।
একটু পর এলেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। এলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। সাংসদ জাহাঙ্গীর কবির নানক। সৈয়দ হকের শেষ গন্তব্য নিয়ে সংস্কৃতিমন্ত্রী টেলিফোনে কাউকে কিছু জানাচ্ছিলেন। চারদিকে কেউ সুলেখকের কীর্তি নিয়ে কথা বলছিলেন, কেউ করছিলেন ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা। নাটকপাড়ার তরুণ কর্মীরাও এসেছেন। তাঁরা শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন কবিকে।
শেষ গোসল করানো হবে কবিকে এখানে। তারই তোড়জোড় চলছে। এরপর আবার তাঁকে নেওয়া হবে ইউনাইটেড হাসপাতালের হিমঘরে।
মঞ্জুবাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় গেটের সামনে শোনা গেল মো. সানাউল্লাহ মিয়ার বুকফাটা আর্তনাদ। সৈয়দ শামসুল হকের গাড়িচালক তিনি। ১৯৯৬ সাল থেকে তাঁর গাড়ি চালাচ্ছেন। কীভাবে সৈয়দ হক তাঁর খোঁজখবর রাখতেন, তা বলছিলেন তিনি। কান্নায় তাঁর কণ্ঠরোধ হয়ে আসছিল। আর আমাদের মনে পড়ছিল পরানের গহীন ভিতর-এর দুটি পঙ্‌ক্তি, ‘মানুষ কি জানে ক্যান মোচড়ায় মানুষের মন,/ অহেতুক দুঃখ দিয়া কেউ ক্যান এত সুখ পায়?’
দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে রাত নয়টার দিকে আমরা যখন মঞ্জুবাড়ি ছেড়ে আসছি, তখনো মানুষ আসছিল সেখানে।
আজকের কর্মসূচি
সকাল ১০টায় সৈয়দ শামসুল হকের লাশ নেওয়া হবে চ্যানেল আইতে, সেখানে তাঁর প্রথম জানাজা হবে। সাড়ে ১০টায় নেওয়া হবে বাংলা একাডেমিতে। বেলা ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জানানো হবে নাগরিক শ্রদ্ধা। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জামে মসজিদে জানাজার পর তাঁকে হেলিকপ্টারে করে নিয়ে যাওয়া হবে জন্মভূমি কুড়িগ্রামে। সেখানে সরকারি কলেজ মাঠের পাশে কবির নির্ধারণ করে দেওয়া স্থানেই তাঁকে দাফন করা হবে।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শোক: সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।

No comments:

Post a Comment